বাংলাদেশ থেকে ভারতে উচ্চশিক্ষা নিতে চাওয়ার চিন্তা মাথায় আসলেই প্রথমে আসে একগুচ্ছ প্রশ্ন— খরচটা কেমন হবে? ডিগ্রিটা বিদেশে স্বীকৃত কিনা? ওখানকার পরিবেশ, নিরাপত্তা, জীবনযাপন—সবকিছু ঠিকঠাক তো?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝকঝকে brochure আর official website-এর প্রতিশ্রুতিময় ভাষায় মিলেও যায়। কিন্তু সেই চকচকে লেখার আড়ালে যে বাস্তব জীবন আছে—লেকচার হল, হোস্টেল, নতুন সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার গল্প—সেগুলোর ছবি অনেক সময়ই বাইরে আসে না।
এই লেখার উদ্দেশ্য ঠিক সেই পর্দাটা সরানো: একজন বাস্তব শিক্ষার্থীর চোখে দেখা ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের আসল অভিজ্ঞতা তুলে ধরা।
শারদা ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করা ছাত্রের চোখে ভারতের উচ্চশিক্ষা: ৫টি বিস্ময়কর সত্যি
আজকের এই আলোচনাটি গতানুগতিক নয়। আমরা সরাসরি শুনব শারদা ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা একজন বাংলাদেশী ছাত্র, সুমিতের অভিজ্ঞতা। তার চোখে দেখা ভারতের উচ্চশিক্ষার এমন কিছু বিস্ময়কর সত্য আমরা তুলে ধরব, যা আপনার এতদিনের ধারণাকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। চলুন, প্রথাগত তথ্যের বাইরে গিয়ে একজন শিক্ষার্থীর বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জেনে নেওয়া যাক আসল সত্যিগুলো।
১. সত্য ১: তিন বছরের ডিগ্রি নিয়ে দুশ্চিন্তা? আসল ব্যাপার হলো 'ক্রেডিট'!
বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি সাধারণ উদ্বেগ হলো, ভারতের তিন বছরের B.Sc. ডিগ্রির মান বাংলাদেশের চার বছরের ডিগ্রির সমান হবে কিনা, বা এই ডিগ্রি নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা যাবে কিনা। সুমিতের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল।
আসল ব্যাপার হলো, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডিগ্রির মেয়াদকাল দেখে না, তারা দেখে আপনি কতগুলো কোর্স 'ক্রেডিট' সম্পন্ন করেছেন। সাধারণত, উচ্চশিক্ষার জন্য প্রায় ১২০ ক্রেডিটের প্রয়োজন হয়, যা ভারতের তিন বছরের কোর্সে সহজেই অর্জন করা সম্ভব। সুতরাং, আপনার ডিগ্রির মেয়াদ তিন বছর হলেও, প্রয়োজনীয় ক্রেডিট সম্পন্ন করলে তা আপনার ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবনে কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না।
২. সত্য ২: চার বছরের কোর্স শেষ হয় তিন বছরে!
এটি সম্ভবত সবচেয়ে অবাক করা তথ্যগুলোর মধ্যে একটি। শারদা ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে একাডেমিক প্রোগ্রামগুলো তাদের নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়ে যায়। সুমিতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, তার তিন বছরের কোর্সটি প্রায় দুই বছর তিন-চার মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। একইভাবে, একটি চার বছরের কোর্সও প্রায় তিন বছরে শেষ করা সম্ভব।
এর প্রধান কারণ হলো ইউনিভার্সিটির অত্যন্ত দক্ষ এবং কঠোরভাবে অনুসরণ করা একাডেমিক ক্যালেন্ডার। কোভিডের পর দ্রুত সেশন শেষ করার অভিজ্ঞতা থেকে তারা একটি কার্যকরী ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যেখানে প্রতি এক বছর পর প্রায় দেড় মাসের লম্বা বিরতি থাকে, কিন্তু কোনো "সেশন জ্যাম" হয় না। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তির সময়েই আপনাকে সম্পূর্ণ একাডেমিক ক্যালেন্ডার দিয়ে দেয়। ফলে, আপনি আজ থেকে কয়েক বছর পর ঠিক কোন তারিখে আপনার গ্র্যাজুয়েশন হবে, তা আগে থেকেই জানতে পারেন, যা পরিকল্পনা করার জন্য একটি বিশাল সুবিধা।
৩. সত্য ৩: শুধু পড়াশোনা নয়, এখানে ব্যক্তিত্বের আমূল পরিবর্তন ঘটে।
ভারতে পড়াশোনা কেবল একটি ডিগ্রি অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি ব্যক্তিত্ব বিকাশের একটি অসাধারণ সুযোগ। শারদা ইউনিভার্সিটিতে প্রায় ৬৫টিরও বেশি দেশের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করে। এই বহুজাতিক পরিবেশে "ভিন্ন ভিন্ন ল্যাঙ্গুয়েজ, ভিন্ন ভিন্ন কালচারের" মানুষের সাথে মেশার ফলে শুধু আত্মবিশ্বাসই বাড়ে না, বরং একজন শিক্ষার্থী বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার প্রথম পাঠ পায়।
এই পরিবর্তন কতটা গভীর হতে পারে, তা সুমিতের নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই স্পষ্ট। ভারতে আসার আগে যিনি মানুষের সাথে কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করতেন, তিনিই এখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অনর্গল কথা বলতে পারেন। এই পরিবেশ একজন শিক্ষার্থীর কমিউনিকেশন স্কিল এবং আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
"সুমিত আর আমি যখন প্রথমে এসেছিলাম, আমি মানুষের সাথে কথা বলতেও সংকোচ করতাম। কিন্তু এখন আমি তোমার সামনে ক্যামেরায় কথা বলছি। তুমি দেখতেই পাচ্ছ, সুমিত চাইলে এখন একটা স্টেজে দাঁড়িয়ে অনর্গল কথা বলতে পারবে। আপডেটটা কী হলো? সুমিতের পার্সোনালিটি আপডেট হয়েছে।"
৪. সত্য ৪: B.Sc. নাকি B.Tech? কোনটি আপনার জন্য?
কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়তে ইচ্ছুক অনেক শিক্ষার্থী B.Sc. এবং B.Tech-এর মধ্যে পার্থক্য নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগেন। সুমিতের সাক্ষাৎকার থেকে এই দুটি কোর্সের মধ্যে একটি পরিষ্কার, ক্যারিয়ার-কেন্দ্রিক চিত্র পাওয়া যায়।
- B.Tech (Bachelor of Technology): এই কোর্সটি তাদের জন্য, যারা ভবিষ্যতে সরাসরি "সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার" হতে চান বা "কোডিং লাইনে" ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী। এটি একটি টেকনিক্যাল এবং প্র্যাকটিক্যাল-ভিত্তিক কোর্স, যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রচুর হ্যান্ডস-অন প্রজেক্ট এবং ল্যাবের কাজ করতে হয়।
- B.Sc. (Bachelor of Science): এই কোর্সটি তুলনামূলকভাবে বেশি থিওরি এবং গবেষণা-ভিত্তিক। যারা ভবিষ্যতে গবেষণা, ডেটা সায়েন্স বা অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে যেতে চান, তাদের জন্য এটি বেশি উপযুক্ত। যদিও উভয় কোর্সের সিলেবাসের ৭০-৮০% মিল রয়েছে, মূল পার্থক্যটি প্রায়োগিক কাজের ধরনে।
সুতরাং, আপনার লক্ষ্য যদি হয় প্রজেক্ট-ভিত্তিক কাজ করে সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করা, তবে B.Tech সেরা। আর যদি গবেষণা বা থিওরির গভীরে যেতে চান, তবে B.Sc. বেছে নেওয়া উচিত।
৫. সত্য ৫: র্যাগিং বা সিনিয়রদের ভয়? ক্যাম্পাসের ভেতরের চিত্র ভিন্ন।
বিদেশের ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা, বিশেষ করে র্যাগিং বা সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক নিয়ে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থী চিন্তিত থাকেন। সুমিতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, শারদা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস অত্যন্ত নিরাপদ এবং সহযোগিতাপূর্ণ।
শারদা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে র্যাগিং বা সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজন নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। এখানে পরিবেশটা আশ্চর্যরকম সহযোগিতাপূর্ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ।
সুমিতের কথায়, আমার হোস্টেল লাইফই ছিল আসল ক্যাম্পাস লাইফের থেকেও বেশি মজা।
শুরুতে, হ্যাঁ—নিজের দেশ, পরিবার, পরিচিত মানুষদের থেকে দূরে এসে কিছুটা একাকিত্ব লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই অনুভূতিটা বেশিদিন টিকে না।
কয়েক দিনের মধ্যেই হোস্টেলের রুমমেট, ক্লাসের বন্ধু, আর নানারকম দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপচারিতা জীবনে নতুন উষ্ণতা আনে। ধীরে ধীরে এখানকার প্রাণবন্ত ক্যাম্পাস, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এবং আন্তরিক কমিউনিটির মধ্যে আপনি নিজেকে পুরোপুরি খুঁজে পাবেন।
In short: At Sharda, you don’t just find classmates — you find a second family. The warmth of the hostel, the diversity of the campus, and the absence of senior-junior hierarchy make it a truly safe and welcoming place to grow, learn, and belong.
সুমিতের অভিজ্ঞতা থেকে এটি স্পষ্ট যে, ভারতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা কেবল একটি ডিগ্রি অর্জন নয়, বরং এটি একটি জীবন পরিবর্তনকারী যাত্রা। এখানে আপনি শুধু একাডেমিক জ্ঞানই লাভ করবেন না, বরং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সাথে পরিচিত হবেন, আত্মবিশ্বাস অর্জন করবেন এবং একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পাবেন।
